তারাপদ আচার্য্য :
বৈশাখের সঙ্গে বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক যেমন নিবিড়, তেমনি অর্থনৈতিক সম্পর্কও তাৎপর্যপূর্ণ। পহেলা বৈশাখ ও নববর্ষ বাঙালির বিজয় পতাকা আকাশে তুলে ধরে। বাঙালির এই বিজয় হচ্ছে সংস্কৃতির বিজয়। এই সাংস্কৃতিক বিজয়ের ফল ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালির এই সর্বজনীন উৎসব।
আমরা বাঙালি হিসেবে গর্বিতবোধ করি। বাংলা ভাষা বাংলাদেশ নিয়েও আমাদের গর্বের শেষ নেই। আমাদের গর্বের কারণ হচ্ছে আমরা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে পেয়েছি। আর হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি ও কৃষ্টি আমাদের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের ধারক বাহক বাঙালি। এই বাঙালি সংস্কৃতির চিরায়ত রূপ ফুটে ওঠে বাংলা নববর্ষের দিনে। এই দিন বাংলা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির সমগ্র সত্তা অস্তিত্ব ও অনুভবের সঙ্গে মিশে আছে। এটা বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জ্বল দিক। প্রতিবছরই শান্তিপূর্ণভাবে দেশব্যাপী বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। দেশের কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে এবং নির্বিঘ্নে ও স্বচ্ছন্দে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হতে পারে সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তা। নববর্ষের দিন দেশব্যাপী সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। বর্ষবরণের মাধ্যমে বাঙালি তার শেকড়ে ফিরতে পারে। নিজস্ব সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করতে পারে নতুনভাবে। বাঙালির প্রাণের আবেগ ও ভালোবাসা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এই দিনে।
বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আমাদের প্রাণের অনুষ্ঠান। পহেলা বৈশাখ আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। আর এ ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান কোনো গোষ্ঠী বা কোনো নির্দিষ্ট মতের মানুষের অনুষ্ঠান নয়। এটা সার্বজনীন, সব ধর্ম-বর্ণ ও মতের অনুষ্ঠান। তাই তো দল-মত নির্বিশেষে, মানুষের স্রোতে বর্ণিল হয়ে ওঠে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। বাঙালি মেতে ওঠে নিজস্ব প্রাণের আবহে। যার প্রধান প্রেরণা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি।
বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে স্বপ্ন নিয়ে এ দেশের মানুষ দেশ স্বাধীন করেছিল_ সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে উৎসব একটি বড় ব্যাপার। দেশের প্রতি প্রেম, সংস্কৃতির প্রতি প্রাণের ভেতর থেকে উঠে আসা ভালোবাসা এই উৎসবের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।
তবে এ কথাও সত্য, আমরা নিজস্ব সত্তা ও স্বাতন্ত্র্য যে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেছি এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। গ্রামবাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য গ্রামীণ মেলা এখন আর আগের মতো বসে না। পুতুল নাচ, যাত্রাপালা, জারি, সারি, ভাটিয়ালি গানের দিন শেষ। গ্রামীণ খেলা, দাঁড়িয়াবাঁধা, গোল্লাছুট, কানামাছি, হাডুডু, লাঠিখেলা গ্রামীণ জনপদে তেমন একটা দেখা যায় না। কৃষিজমি দখল করে সেখানে তৈরি করা হয়েছে ইটভাটা না হয় করা হচ্ছে হাউজিং বা শপিংমল। নগরায়নের ছাপ পড়ছে সর্বত্র। এটাকে ছাপ না বলে গ্রাস বলাই সঙ্গত। নদীতে পাল তোলা নৌকা এখন আর চোখে পড়ে না। ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না।’ এ কথা এখন আর কেউ বলে না। নদী এখন ইঞ্জিনচালিত নৌকা দখল করে নিয়েছে। আর নদীর স্বচ্ছ পানি দখল করে নিয়েছে নাগরিক বর্জ্য। রাখাল গরুর পাল নিয়ে আর মাঠে যায় না। গ্রামীণ সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে দখল করে নিয়েছে নগর। যে নগর পশ্চিমা সংস্কৃতির আবহে উচ্ছ্বসিত ও ভারাক্রান্ত।
সংস্কৃতি হচ্ছে জীবনের দর্পণ। এটা নিরন্তর চর্চার বিষয়। মুখে এক আর কাজে অন্য এভাবে আর যাই হোক বাঙালি সংস্কৃতি চর্চাকে বেশিদূর এগিয়ে নেয়া যাবে না। মনুষ্যত্ব তথা মানবধর্মের সাধনাই হচ্ছে সংস্কৃতি। আমরা যা ভাবি পছন্দ করি এবং যা প্রতিদিনের জীবনাচরণে প্রতিফলিত হয় সেটাই আমাদের সংস্কৃতি। সংস্কৃতি মানে নিজস্বতা নিয়ে সুন্দরভাবে বিচিত্রভাবে বেঁচে থাকা।
অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে বাংলা নববর্ষ বরণ বাঙালি জাতিসত্তাকে নতুনভাবে জাগ্রত করে। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও এ জাতি তার স্বাধীনতা রক্ষা করবে, রক্ষা করবে প্রাণের চেয়ে প্রিয় এ ভাষা, হাজার বছরের সংস্কৃতি। তারই জ্বলন্ত প্রমাণ বাংলা নববর্ষ উদযাপন।
বাঙালি জাতি গানে-কবিতায়, নানা লোকাচারে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দূর অতীত থেকেই বয়ে চলেছে নববর্ষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সম্রাট আকবরের শাসনামলে কৃষিনির্ভর বাংলায় বৈশাখে নববর্ষ উদযাপন চালু হয়েছিল, নানা বিবর্তনে তা আজো বহমান। এ দেশের বৃহত্তম অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে সর্বস্তরের মানুষের কাছে বাংলা নববর্ষ বহুকাল ধরে বরণীয়। চৈত্রসংক্রান্তির নানা লোকাচার আর নববর্ষ বরণে কৃষিজীবী সমাজের বিচিত্র আয়োজন লোকায়ত উৎসব হিসেবেও তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও বৈশাখের গুরুত্ব যথেষ্ট।
বৈশাখের সঙ্গে বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক যেমন নিবিড়, তেমনি অর্থনৈতিক সম্পর্কও তাৎপর্যপূর্ণ। পহেলা বৈশাখ ও নববর্ষ বাঙালির বিজয় পতাকা আকাশে তুলে ধরে। বাঙালির এই বিজয় হচ্ছে সংস্কৃতির বিজয়। এই সাংস্কৃতিক বিজয়ের ফল ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালির এই সর্বজনীন উৎসব।
প্রতি বছরের মতো রাজধানী ঢাকায় এবারো রমনায় ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাঙালির বর্ষবরণ শুরু হবে। এই অনুষ্ঠানটিও এখন বাঙালির ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। ঐতিহ্য এ কারণে যে, পাকিস্তানি শাসনামলে নববর্ষ উদযাপনকে বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে আখ্যায়িত করেছিল। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৬৭ সালে ছায়ানট রমনার বটমূলে বর্ষবরণ উৎসবের আয়োজন করেছিল। এতে হাজার হাজার বাঙালি যোগ দিয়েছিল। সে ঐতিহ্য আজো অমস্নান। দেশের প্রতি, সংস্কৃতির প্রতি এ দেশের মানুষের যে প্রেম_ তারই প্রকাশ ঘটে বর্ষবরণের মাধ্যমে। পহেলা বৈশাখের মতোই জাতির প্রতিটি উৎসব হয়ে উঠুক আনন্দময়। জয় হোক বাংলা, বাঙালি আর বাঙালি সংস্কৃতির।
বাংলা নববর্ষ ও বাঙালি সংস্কৃতি
প্রকাশ : Apr 07, 2016 | Comments Off on বাংলা নববর্ষ ও বাঙালি সংস্কৃতি