logo

মাওলানা মুহাম্মদ এখলাছুদ্দীন রাহ. এর ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী

মো. বোরহান উদ্দিন খাঁনঃ

বিশিষ্ট আলেমে দীন, শিক্ষানুরাগী মাওলানা মুহাম্মদ এখলাছুদ্দীন কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া থানাধীন মসনদে আলা ঈসা খানের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক এগারসিন্দুর গ্রামে ১৯৩৮ সালে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোঃ আবদুল হাফেজ পন্ডিত। মাতার নাম মুরতাযা খাতুন।

মাওলানা এখলাছুদ্দীন রাহ. একজন ক্ষণজন্মা মেধাবী ছিলেন। তিনি ষাটের দশকে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ঢাকা থেকে হাদিস শাস্ত্রে কামিল (মুমতাযুল মুহাদ্দিসীন) ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবনের সকল স্তরে তিনি প্রথম শ্রেণি এবং বৃত্তিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে তাঁর পিতার ইন্তেকাল, এলাকার শিক্ষার অভাবে তাঁর দুশ্চিন্তা, নাগরিক জীবন যাপনে অপছন্দ এবং পারিবারিক টানাপড়েন ইত্যাদি কারণে তিনি গ্রামমুখী কর্মজীবনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি যখন নিজগ্রাম কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক এগারসিন্দুর গ্রামে ফিরে আসেন। তখনকার সময়ে ঐ অঞ্চলে দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল একেবারে নগন্য।

এগারসিন্দুর স্থানটি ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত থাকলেও এ গ্রামে স্বীকৃত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। তিনি এ অবস্থায় গ্রামের কতিপয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় পুর্নোদ্দমে শুরু করেন শিক্ষা বিস্তার কার্যক্রম। প্রতিষ্ঠা করেন এগারসিন্দুর ঈসা খান মাদরাসা। এখানেই শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। ইতিহাসে এগারসিন্দুর স্থানটি বাংলার প্রাচীন জনপদ হিসেবে স্বীকৃত। এখানে বাংলার মহান বীর মসনদে আলা ঈসা খানের কর্মযজ্ঞ ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত এগারসিন্দুর শাহ মাহমুদ মাসজিদ এবং শেখ সাদী মাসজিদের অবস্থান রয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, সাড়ে তিনশত বছর পূর্বেও এগারসিন্দুরে ইসলামি শিক্ষা ও সভ্যতা বিদ্যমান ছিল। অথচ কালের আবর্তে সভ্যতার নিশানা প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল। ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গের অস্তিত্ব খোঁজে পাওয়া ছিল দুরূহ। ঈসা খানকে এগারসিন্দুরে স্মরণীয় করে রাখার মতো কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান ছিল না। এ অবস্থা থেকে তিনি উত্তরণের চেষ্টা করেন।

পরবর্তীতে, এলাকাবাসীর একান্ত আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় এ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন এগারসিন্দুর ঈসা খান বালিকা বিদ্যালয়, ঈসা খান প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঈসা খান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি মক্তব-মাদরাসা। তিনি ঈসা খান আলিয়া মাদরাসায় সুপরিনটেনডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন ছাড়াও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরূপে এবং মঠখোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছেন। তিনি জীবদ্দশায় এগারসিন্দুর শাহ মাহমুদ শাহী মাসজিদের খাতীব, শাহী ঈদগাহের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ তিনি পাকুন্দিয়া উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স জামে মাসজিদের খাতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

মাওলানা এখলাছুদ্দীন কিশোরগঞ্জসহ প্রায় সারা দেশে দীনী দাওয়াতের কাজে সফর করেছেন। কর্মজীবনে চাকরিকাল তাঁর কাছে জীবিকা নির্বাহের উপায় ছিল। মুখ্য ছিল তাঁর দীন প্রচার। একজন দাঈ ইলাল্লাহ হিসেবে তিনি তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে তিনি সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বিভিন্নস্থানে অনুষ্ঠিত ওয়াজ মাহফিলে কুরআন-হাদীসভিত্তিক যুক্তিপূর্ণ বয়ান করতেন। তাঁর আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল মানুষ গড়া। মানব সৃষ্টি, এর উদ্দেশ্য, কর্ম এবং যাপিত জীবন সম্পর্কে সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ করতেন। কল্যাণকর সমাজ বিনির্মাণে সৎ, দক্ষ, নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ, অনুশীলনকারী মুসলিমের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করতেন। সামাজিক অবক্ষয়রোধ ও দীনী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় তিনি সবসময় সচেষ্ট থাকতেন। তিনি সবসময় বলতেন, ‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’ তিনি আলোচনায় সাধারণত অমূলক কিসসা কাহিনী বর্ণনা করতেন না। সরাসরি কুরআনুল কারীম ও সহীহ হাদীস থেকে আলোচনা করতেন। তাঁর আলোচনায় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ বেশী উপকৃত হতেন। সাধারণ মানুষেরাও তাঁর আলোচনা থেকে দৈনন্দিন জীবন চলার পথের দিশা খোঁজে পেতেন। তিনি শিরক, বিদআত ও ধর্মীয় কুসংস্কার উচ্ছেদে আজীবন আপসহীন সংগ্রাম করেছেন। ভন্ড পীর ও বিদআতীরা তাঁর নাম শুনলেই কেঁপে ওঠতো। তাঁর গ্রামে অনেকগুলো মাজার থাকা সত্বেও এখানে তাঁর প্রচেষ্টায় কোন শরিয়ত বিরোধী তৎপরতা নেই। বিদআতীদের বিরুদ্ধে তিনি ওয়ায মাহফিলে প্রকাশ্যে বক্তৃতা করেছেন।

মাওলানা মুহাম্মদ এখলাছুদ্দীন (রাহ:) শিক্ষা প্রসারে আজীবন নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। পাকুন্দিয়া, কটিয়াদী, গফরগাঁও, কাপাসিয়া, মনোহরদীসহ বিভিন্ন এলাকায় দীনি কিংবা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা পরিচালনার ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি বহুবছর তারাকান্দি আবদুল হালিম হুসাইনিয়া ইয়াতীমখানার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও, তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন সাহিত্য, তমদ্দুনিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। কিশোরগঞ্জ সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের উদ্যোগে মসনদে আলা ঈসা খানের ৪০০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এগারসিন্দুর ঈদগাহে সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি এ সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। সম্মেলনে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনেক জাতীয় ব্যক্তিত্ব, কবি-সাহিত্যিক, আলিম-উলামা অংশগ্রহণ করেন।

মাওলানা মুহাম্মদ এখলাছুদ্দীন (রাহ:) দীর্ঘ ০৪ মাস রোগ ভোগের পর ৭২ বছর বয়সে ২৬ মে ২০০৯, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৬ বঙ্গাব্দ, ০১ জমাদিউস সানী ১৪৩০ হিজরী সন, রোজ : মঙ্গলবার, সূবহি সাদিকের সময় ৫.১০ মি: নিজ বাড়িতে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ৪ ছেলে ও ৫ মেয়ে রেখে যান। তাঁ নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছিল মঠখোলা হাজী জাফর আরী কলেজ মাঠে। বিভিন্ন জেলার অসংখ্য মানুষ, ভক্তকূল তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করেন। বলা হয়ে থাকে, এটি ছিল এলাকার স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জানাযা।

আমরা তাঁর সন্তান হিসেবে মহান রবের কাছে তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি। “রব্বির হামহুমা কামা রব্বাইয়ানি সগীরা-“হে আমার রব্ব! আমার পিতা-মাতার প্রতি দয়া করুন, যেমন তাঁরা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন”।

Comments are closed.







প্রধান সম্পাদক : ফজলুল হক জোয়ারদার আলমগীর, সহ-সম্পাদক : দেলোয়ার হোসেন শরীফ।
বার্তা সম্পাদক - মাসুম পাঠান, প্রধান কার্যালয়: ১৩/এ মনেশ্বর রোড, হাজারিবাগ, ঢাকা- বাংলাদেশ।
জোনাল অফিস: বাংলাদেশ কম্পিউটার এন্ড টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট, কটিয়াদী বাজার (অগ্রনী ব্যাংক নিচতলা), কিশোরগঞ্জ।
ফোন : ০১৭১১-১৮৯৭৬১, ০১৭১১-৩২৪৬৬০, ০১৭৩২-১৬৩১৫৭।
ই-মেইল: news@ghatanaprobaha.com, ওয়েবঃ- www.ghatanaprobaha.com
ডিজাইন: একুশে