ডিপ্লোমা বেকার নার্সদের আন্দোলনের প্রতি কর্ণপাত নেই কারো। তাদের লাগাতার অবস্থান-ধর্মঘটের দাবি-দাওয়ার বিষয়টিকে এড়িয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এমনটি অভিযোগ করেছেন আন্দোলনরতরা। ১০ দিন যাবৎ বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন সচিবালয়ের (বিপিএসসি) কর্তৃক প্রকাশিত নার্স নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিলের দাবি জানিয়েছে নার্সদের সংগঠন বাংলাদেশ ডিপ্লোমা বেকার নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (বিডিবিএনএ) ও বাংলাদেশ বেসিক গ্র্যাজুয়েট নার্সেস সোসাইটি (বিবিজিএনএস)।
এদিকে আন্দোলন চলাকালীন দ্রুত দাবি বাস্তবায় না হলে আগামী ১৬ এপ্রিল বেলা ১১টা এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমরণ অনশন ও আত্মাহুতির ঘোষণা দিয়েছে নার্সরা। মঙ্গলবার দুপুরে বেকার নার্সদের দুটি সংগঠনের নেতারা এ কথা জানান। সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, দাবি বাস্তবায়নের জন্য সারাদেশের ২১ হাজার ৫শ’ নার্সদের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার নার্স গত ৪ এপ্রিল থেকে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে অবস্থান ধর্মঘট পালন অব্যাহত রাখছেন।
অনেকে কর্মসংস্থানের তাড়নায় ছেলেমেয়ে বাড়িতে রেখে এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। ১০ দিন যাবৎ অনেকে খাওয়া না খেয়ে ক্ষুধার্ত আছেন। অথবা আন্দোলনকারীদের মধ্যে কেউ সামান্য খাবার দিলে তা দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছেন। এই অবস্থায় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন নার্সরা। শত শত নার্স অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আন্দোলন চলাকালে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সংশ্লিষ্ট মহল তাদের প্রতি সহানুভূতি পর্যন্ত দেখায়নি গতকাল পর্যন্ত। নার্স ফারজানা এমি মানবকণ্ঠকে বলেন, আন্দোলনের অনেক দিন পেরিয়ে গেলেও সরকারের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেউ এ দাবি বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে আসছে না।
আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বিবিজিএনএসের সভাপতি রাজীব কুমার বিশ্বাস বলেন, আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ২০১৬ সালের ৬ আগস্ট থেকে। তিনি বলেন, অমাদের সংগঠন দুটির উত্থাপিত একদফা দাবি হচ্ছে, অবিলম্বে বিপিএসসির প্রকাশিত নার্স নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে জনস্বার্থে আগের মতো ব্যাচ, মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিক্তিতে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নতুন সৃজিত ‘সিনিয়র স্টাফ নার্স’-এর শূন্যপদে ১৩ হাজার ৭২৮টি পদের মধ্যে, ডিপ্লোমা নার্সিং থেকে ৮৯ শতাংশ পদে ও বেসিক বিএসসি ইন নার্সিং ডিগ্রিধারীদের মধ্য থেকে ১১ শতাংশ পদে দ্রুত নিয়োগ বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশে ডিপ্লোমা বেকার নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রিনা আক্তার বলেন, আমাদের দাবির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ২৮ মার্চ পিএসসি ৩ হাজার ৬১৬ সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। তাই এ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে আগের মতো জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নার্স নিয়োগ দিতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের নার্সদের বয়সসীমা ৩৬ বছরে উন্নীত করতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দাবি পূরণ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।
বাংলাদেশ ডিপ্লোমা বেকার নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারুক হোসাইন বলেন, এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে দাবির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনই নয়, পাশাপাশি দেশের সব নার্স নেতাদের মতামতকেও অগ্রাহ্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, সর্বস্তরের নার্স-সমাজ এই ঘটনার প্রতিবাদস্বরূপ ৩০ মার্চ রাজধানীর শাহবাগে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিলাম। আর সেখানেই আর্ত-পীড়িত মানুষের সেবক নার্স সমাজ নির্মম পুলিশি আক্রমণের শিকার হয়। পুলিশ নির্মমভাবে শান্তিপ্রিয় নার্স সমাজের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ, কাঁদানো গ্যাস, পেপার স্প্রে ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। সেই অর্ধ-শতাধিক নার্স আহত হয়েছে বলে তিনি জানান।
এই ঘটনার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজশাহী থেকে আসা মুক্তা রানী দাস বলেন, ইতিমধ্যেই নার্স মাতা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এই পুলিশি আক্রমণ ও নারী লাঞ্ছনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আবেদন জানিয়েছি এবং দাবি বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ প্রার্থনা করছি। আন্দোলনরত এই নার্স বলেন, দাবি আদায়ে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৪ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে আমরা প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে কর্মসূচির ১০দিনেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দাবির অগ্রগতির বিষয়ে কোনো কিছুই অবহিত করেননি। এমতাবস্থায় আমরা চলমান অবস্থান ধর্মঘট থেকে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা ও দাবি বাস্তবায়নে পুনরায় দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করব খুব শিগগিরই।
এদিকে খুলনা থেকে আসা শারমিন ইয়াসমিন নামে এক নার্স বলেন, আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই যতদিন পর্যন্ত আমাদের দাবি বাস্তবায়িত না হবে ততদিন পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে এবং ক্রমেই এই আন্দোলন কর্মসূচি জোরালো হতে থাকবে। উত্থাপিত এক দফা দাবি পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট অব্যাহত রাখতে সারাদেশ থেকে হাজার হাজার নার্স যোগ দেবে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ ডিপ্লোমা বেকার নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (বিডিবিএনএ) এবং বাংলাদেশ বেসিক গ্র্যাজুয়েট নার্সেস সোসাইটি (বিবিজিএনএস) যৌথভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারের কাছে ব্যাচ, মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নার্স নিয়োগের ১ দফা দাবি উত্থাপনের পাশাপাশি গণসচেতনতামূলক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছে। সংগঠন দুটির নেতারা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের আগস্টে সরকারি পর্যায়ে নার্সিং কর্মকর্তার ঘাটতি লাঘবে ১০ হাজার নার্সের পদ সৃজনের ঘোষণা দেন। বর্তমান নার্সবান্ধব প্রধানমন্ত্রী ইতিপূর্বেও দুই ধাপে ব্যাচ, মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রায় ছয় হাজার পাঁচশ’ নার্স নিয়োগ দিয়েছেন। তারা অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে নার্সিং কর্মকর্তার ব্যাপক ঘাটতি সত্ত্বেও বর্তমানে ডিপ্লোমা-ইন-নার্সিং ডিগ্রিধারী এবং বিএসসি-ইন-নার্সিং ডিগ্রিধারী বেকার নার্সের সংখ্যা সর্বমোট প্রায় ২১ হাজার ৫০০। এক কথায় বলা যায় বাংলাদেশে নার্সিং পেশা অত্যন্ত সংকটময়। এমতাবস্থায় সংকটময় নার্সিং পেশার সার্বিক উত্তোরণে ও অধিকার বঞ্চিত বেকার নার্সদের অধিকার রক্ষায় আমরা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ব্যাচ, মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নার্স নিয়োগের জোর দাবি জানিয়ে আসছি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বেসিক গ্র্যাজুয়েট নার্সেস সোসাইটির সভাপতি রাজীব কুমার বিশ্বাস বলেন, বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আদর্শ অনুপাত অনুসারে প্রায় ২ লাখ নার্সিং কর্মকর্তার অভাব রয়েছে। সেই দেশে পরীক্ষা-পদ্ধতির নামে সরকার কাদের ছাঁটাই করতে চায়? স্পষ্টতই এটি একটি নিয়োগ বাণিজ্য মাত্র।
বাংলাদেশ বেসিক গ্রাজুয়েট নার্সেস সোসাইটির (বিবিজিএনএস) সাধারণ সম্পাদক নাহিদা আক্তার বলেন, আকস্মিকভাবে পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমেই যদি নার্স-নিয়োগ বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ কেন হাজার হাজার নার্স সুবিধা-বঞ্চিত রাখা হয়েছে? রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্তির পর একাধিকবার নার্স নিয়োগ হলেও কেন হাজার হাজার নার্স তখন চাকরির আবেদন করতে পারেননি? এহেন দুর্বিসহ পরিস্থিতিতে যদি মানবতার সেবক কোনো নার্স আত্ম-হননের পথ বেছে নেন, তাহলে সরকারকেই সম্পূর্ণরূপে এর দায়ভার বহন করতে হবে।
ডিপ্লোমা বেকার নার্সদের আমরণ অনশন ও আত্মাহুতির ঘোষণা আসছে
প্রকাশ : Apr 13, 2016 | Comments Off on ডিপ্লোমা বেকার নার্সদের আমরণ অনশন ও আত্মাহুতির ঘোষণা আসছে